বাংলাদেশের ‘লাল জুলাই’: এক ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া এক গণজাগরণ আজ ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে “লাল জুলাই” নামে। এই সময়কালে ছাত্র ও তরুণ সমাজের সম্মিলিত প্রতিবাদ আন্দোলন দেশকে এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে পৌঁছে দেয়। ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ থেকে শুরু হয়ে তা রূপ নেয় রাষ্ট্রীয় স্তরের পরিবর্তনে। ইতিহাসে বিরল এক গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী হয় বাংলাদেশ।
🔹 আন্দোলনের সূচনা
২০২৪ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে কোটা সংস্কার দাবিতে শুরু হয় একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে পুরাতন কোটাব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের ঘোষণা আসে, যা মেধাভিত্তিক নিয়োগে বড় বাধা হিসেবে দেখা দেয়। শিক্ষার্থীরা সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
প্রথম দিকে দাবি ছিল প্রশাসনিক আলোচনা ও নীতিগত পরিবর্তনের। কিন্তু সরকারের নিরবতা, পুলিশি বাধা এবং কিছু রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের সহিংস প্রতিক্রিয়ার ফলে এই আন্দোলন রূপ নেয় এক জাতীয় আন্দোলনে।
🔹 দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে
৫ জুলাইয়ের পর রাজধানীর বাইরে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং জেলা শহরে ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলন। “বাংলা ব্লকেড” কর্মসূচি পালিত হয়—যেখানে শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে, সড়ক অবরোধ করে ও বিভিন্ন রেলস্টেশন ঘিরে রাখে। আন্দোলনে অংশ নেয় শিক্ষক, অভিভাবক, চাকরি প্রত্যাশী এবং সাধারণ জনগণ।
পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ ঘটে। সংঘর্ষে কয়েকজন নিহত হন, শতাধিক আহত হন। সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে।
🔹 লাল জুলাইয়ের প্রতীকী তাৎপর্য
এই পুরো জুলাই মাসজুড়ে শিক্ষার্থীদের লাল পোশাক পরা, লাল পতাকা উত্তোলন এবং “লাল জুলাই, লাল প্রতিবাদ” স্লোগান ছিল আন্দোলনের প্রতীক। এই রঙ হয়ে ওঠে প্রতিরোধ, প্রতিবাদ এবং পরিবর্তনের রঙ। অনেকেই একে তুলনা করেন ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে।
শহীদ শিক্ষার্থীদের স্মরণে ক্যাম্পাসে মোমবাতি প্রজ্বলন, গণসংগীত পরিবেশন ও স্বতঃস্ফূর্ত মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি চলে প্রতিদিন।
🔹 রাজনৈতিক পালাবদল
২০ জুলাইয়ের দিকে পরিস্থিতি যখন চূড়ান্ত উত্তেজনায়, তখন সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার আশ্বাস দেওয়া হয়। তবুও নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত না আসায়, আন্দোলন অব্যাহত থাকে। ২২ জুলাই হঠাৎ এক ঘোষণায় রাষ্ট্রপ্রধান পদত্যাগের কথা জানান।
এরপর একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনিক কমিটি গঠিত হয়, যা পরবর্তী নির্বাচন ও প্রশাসনিক সংস্কারের দায়িত্ব নেয়। এই ঘটনার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটে এবং দেশে এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হয়।
🔹 গণতন্ত্রের জন্য তরুণদের লড়াই
এই আন্দোলনে যেভাবে তরুণ সমাজ নেতৃত্ব দেয়, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী উদাহরণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আন্দোলনের লাইভ কাভারেজ, মুহূর্তের মধ্যেই সংবাদ ছড়িয়ে পড়া এবং স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল এই সময়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
তরুণরা প্রমাণ করেছে—তারা কেবল ফেসবুক-টুইটারের প্রজন্ম নয়, বরং আদর্শ ও ন্যায়ের প্রশ্নে রাস্তায় নামতে প্রস্তুত একটি চেতনার বাহক।
🔹 আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিশ্ব গণমাধ্যমে এই আন্দোলন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকারের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং রাজনৈতিক দমন–বিরোধে সমালোচনা হয় আন্তর্জাতিক মহলে। জাতিসংঘ, বিভিন্ন রাষ্ট্র ও মানবাধিকার সংগঠন উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানায়।
🔹 বর্তমান প্রেক্ষাপট
২০২৫ সালের জুলাই এসে, লাল জুলাই-এর এক বছর পূর্ণ হলো। এখন দেশে একটি নির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে। তবে রাজনৈতিক পরিবেশ এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি। তবে জনগণের প্রত্যাশা—নতুন সরকার গণতন্ত্র, সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়বে।
🔚 উপসংহার
“লাল জুলাই” কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি চেতনার নাম। তরুণ সমাজ দেখিয়েছে যে তারা অন্যায় সহ্য করবে না, তারা পরিবর্তনের জন্য জীবন দিতে পারে, তবে মাথা নিচু রাখবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এই আন্দোলন প্রমাণ করেছে—যে দেশ তার তরুণদের কথা শোনে না, সে দেশ আগাতে পারে না। আর এই আন্দোলনই দেখিয়েছে, বাংলার তরুণরা কখনো মাথা নত করে না।