বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মনে করে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর ও অংশগ্রহণমূলক করতে হলে দেশে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR - Proportional Representation) ভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এই পদ্ধতি চালু হলে দেশে ফ্যাসিবাদের উত্থান বন্ধ হবে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান।
শনিবার রাজধানীর গুলশানে একটি অভিজাত হোটেলে কূটনীতিকদের সম্মানে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, পিআর পদ্ধতি চালু হলে জনগণের মতামত আরও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হবে, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে এবং ভবিষ্যতে আর কোনো ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে না।”
ফ্যাসিবাদ রোধে PR পদ্ধতির দাবি
তিনি বলেন, “আমরা চাই একটি ভারসাম্যপূর্ণ সংসদ। পিআর পদ্ধতি চালু হলে ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন হবে, একচেটিয়া ক্ষমতার অপব্যবহার কমবে। গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো একে অপরকে সহযোগিতা করতে শিখবে।”
ডা. শফিকুর রহমান আরও বলেন, "যে দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয় না, সেখানে ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়। পিআর পদ্ধতি সে পথ রুদ্ধ করতে পারে।"
গত ১৫ বছরের 'রাজনৈতিক নিপীড়নের’ চিত্র তুলে ধরেন জামায়াত আমির
বক্তব্যে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “গত ১৫ বছর ধরে জামায়াতে ইসলামী দমন–নিপীড়নের শিকার। আমাদের পাঁচজন শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, হাজার হাজার নেতা–কর্মীকে হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার ও পঙ্গু করা হয়েছে। অথচ আমরা একটি গণতান্ত্রিক দল।”
তিনি আরও বলেন, "২০১৪ সালের পর আমাদের ইফতার আয়োজন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবার সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে আমরা এই আয়োজন করতে পেরেছি।"
কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের উপস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমী
এই ইফতার আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, ইরান, তুরস্ক, ভারত, ভুটান, কানাডা, ব্রাজিল, সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মরক্কো, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরাকসহ ৩০টিরও বেশি দেশের কূটনীতিক ও রাষ্ট্রদূতরা অংশগ্রহণ করেন।
এছাড়াও জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ওআইসি-এর প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
জামায়াত আমির বলেন, “কূটনৈতিক সম্প্রদায়ের এই উপস্থিতি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি ইতিবাচক বার্তা দেয়—সংলাপ ও সহযোগিতার জন্য দরজা খোলা।”
অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকায় আশাবাদ
তিনি বলেন, “বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান ও রাষ্ট্র কাঠামোয় সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, আমরা তাতে স্বাগত জানাই।”
তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
“জুলাই বিপ্লবের” প্রসঙ্গ টেনে অতীত স্মরণ
ডা. শফিকুর রহমান স্মরণ করিয়ে দেন, “১৯৯০-এর দশকে জামায়াতে ইসলামী ছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবেও আমরা জনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম।”
তিনি দাবি করেন, জামায়াতপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো মসজিদ রক্ষা, লুটপাট প্রতিরোধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভূমিকা রেখেছে।
সমালোচনার জবাব ও আত্মবিশ্বাস
বিরোধীদের সমালোচনা প্রসঙ্গে জামায়াত আমির বলেন, “আমরা সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যারা আমাদের রাজনীতি করার অধিকার অস্বীকার করে, তারা প্রকৃত গণতন্ত্রের শত্রু।”
তিনি বলেন, “দেশের জনগণ পরিবর্তন চায়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সেই পরিবর্তন আনতে হলে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।”
বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ নির্দেশনা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পিআর পদ্ধতি চালু হলে শুধুমাত্র জামায়াত নয়, অন্যান্য ছোট রাজনৈতিক দলগুলোরও জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়বে। ফলে সংসদে একক আধিপত্য নয় বরং জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
তবে এই পদ্ধতি চালুর ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক কাঠামোর প্রস্তুতি এবং জনগণের সচেতনতা।
উপসংহার
জামায়াত ইসলামী পিআর ভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রধান চাবিকাঠি হিসেবে দেখছে। এই দাবির মাধ্যমে দলটি বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার চায় এবং এর মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের রুখে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
যদিও এই দাবি অনেকের কাছে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, তবে গণতান্ত্রিক শাসন ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে এই বিতর্ককে সামনে এনেছে নতুন মাত্রা।
সূত্র: নিজস্ব সংবাদদাতা, মাঠ পর্যায়ের তথ্য বিশ্লেষণ এবং কূটনৈতিক সূত্র